• ঢাকা,বাংলাদেশ
  • মঙ্গলবার | ২৮শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ | বসন্তকাল | বিকাল ৩:০৩
  • আর্কাইভ

রুপালি  ইলিশ আর দইয়ের খোজে

৩:০৪ অপরাহ্ণ, আগ ১৬, ২০১৭

স্কুল বন্ধুদের সাথে আড্ডা মানেই সে এক অন্য রকম ভাল লাগা। অনেকদিন ধরেই এ রকম এক আড্ডার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কত তারিখ যে পরিবর্তন হলো কিন্তু আমাদের ঘুরতে যাওয়া হলোনা!  অবশেষে গতকাল দুপুরে আমরা ৪ বন্ধু রামগতির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।

 

২০১২ সালে ও আমার স্কুল বন্ধুরা একবার রামগতি এসেছিল। সে যাত্রায় আমি ছিলাম না। দীর্ঘ বিরতিতে দলের দু-বন্ধু ভুলে গিয়েছিল তারা ঠিক কোথায় গিয়েছিল। একজন বলল আলেকজান্ডার আর অন্যজন রামগতি। অনেক তর্কবিতর্কের শেষে সিদ্ধান্ত হলো পরাজিত বন্ধু ট্যুর এর যাবতীয় খরচ বহন করবে। এ শর্তে আমরা রওয়ানা হলাম। আলেকজান্ডার পৌছাতেই বিকেল ৪ টার বেশি বেজে গেল।

এলাকার লোকজনের পরামর্শে দুপুরের খাবার গ্রহনের জন্য সবচেয়ে ভাল হোটেল হিসেবে ভাণ্ডারী হোটেলে গেলাম। উদ্দেশ্য ইলিশের যত রকম রেসিপি রয়েছে, সবগুলোর স্বাদ গ্রহণ করা। সাথে বিভিন্ন রকমের ভর্তা। দু:খের কথা হলো সেখানে ইলিশের নাগাল আমরা পাইনি। অগত্যা ঝাটকার মাঝেই ইলিশের মজা খুঁজে দুপুরের খাবার শেষ করলাম। ভর্তা, সে তো ছিল অলীক কল্পনা!

খাবার শেষ করে আমার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে  আলেকজান্ডার বাঁধে গিয়ে প্রমত্ত মেঘনার রুপ সুধা অন্বেষণে বের হলাম।

বন্ধু জানালো, জোয়ারের সময় নাকি মেঘনার বুকে যৌবনের ঢেউ লাগে। সে ঢেউ  মনে উতাল পাতাল নাচের সৃষ্টি করে। ভাটার সময়ে যাওয়ায় মেঘনার সে ঢেউ আমাদের মনে সম্মোহনী নাচের পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। অগত্যা দূর থেকে ভেসে আসা মৃদ সমীরণে গা জুড়িয়ে আর বাদাম চিবুতে চিবুতে আমরা কিছুক্ষণ গল্প করে আর কিছু ছবি তুলে  রওয়ানা হলাম রামগতির উদ্দেশে।

মাঝখানের বিরতিতে উপভোগ করলাম পিচ্ছি বাদামওয়ালার টাকার মাইকে করা বিজ্ঞাপনের মডেলিং আর মাঝে মাঝে মাঝ নদী থেকে মাছ ধরে ফিরে আসা বিভিন্ন রঙের পতাকাবাহী ট্রলারের তীরে আসার দৃশ্য।

বিভিন্ন আকৃতি আর  রঙের পতাকার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সত্যিই চমৎকার। জেলেদের সাথে কথা বলে যা জানলাম তা হলো পতাকার রঙ আর আকৃতি নৌকার মালিকের বা আড়তদার এর কোড বহন করে। নির্দিষ্ট রংগের পতাকাবাহী নৌকা মাছ শিকার শেষে একই পতাকাবাহী আড়তে মাছ নিয়ে আসে। সমুদ্রে কোন নৌকা বিপদে পড়লেও জেলেরা দূর হতে পতাকার রঙ দেখে তা চিনতে পারে এবং মালিককে দ্রুত অবহিত করতে পারে এবং সহায়তা করতে পারে।

যাইহোক, আলেকজান্ডার হতে রামগতি যাওয়ার পথ আমার কাছে বড়ই বিচিত্র মনে হলো। কেমন যেন একটা ভৌতিক ভাব বিরাজ করছিল পুরো রাস্তা জুড়ে। ৪-৫ কিলো পরপর বাজার। ওখানে ছাড়া পথেঘাটে মানুষের দেখা মেলা ভার। রাস্তার দুপাশ জুড়ে কেবল খেজুর গাছ  আর খেতের মাঝেমাঝে তালগাছের লম্বা সারি। রাস্তার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে বয়ে চলা ছোট ছোট খাল আর তার আশেপাশের ভেজিটেশন দেখে সহজেই বোঝা যায় নদীর সাথে এ খালগুলোর সংযোগ রয়েছে। জোয়ারের সময় লবনাক্ত পানি প্রবেশ করে এমনভাবে লবণ সহিষ্ণু উদ্ভিদরাজি বেড়ে উঠছে ঠিক যেন রামগতির কোলে জেগে ওঠা এক টুকরো সুন্দরবন।

আনুমানিক সন্ধ্যা ৬ টা ২৫ এর দিকে আমরা অনেক আঁকাবাঁকা, দুর্গম আর নির্জন পথ পাড়ি দিয়ে রামগতির শেষ মাথায় মেঘনার পাড়ে গিয়ে থামলাম। সেখানে গিয়েই দু বন্ধুর বোধোদয় হলো। ৫ বছর আগে তারা ঠিক এ যায়গায় এসেছিল।

২০১২ তে দেখা রামগতির সাথে ২০১৭ এর রামগতির অনেক অমিল। এই চেনা মনে হচ্ছে তো ঐ অচেনা। কেননা এত দিনে মেঘনার গর্বে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। স্থানীয় কিছু মানুষকে আগের কিছু  ছবি দেখিয়ে আমরা জায়গাগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম।

এখানে এসে আমরা মেঘনার ভরা জোয়ার লক্ষ্য করলাম। সেই সাথে পানির কলকল রবের ছন্দের সাথে সাথে মন মাতানো হাওয়া। আর হাওয়ায় ভেসে আসা নেশা ধরানো এক অদ্ভুদ গন্ধ!

একদিকে দিনের বেলা মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলো মাছ ধরে ঘরে ফিরছে আর অন্যদিকে কিছু জেলেরা গভীররাতে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার আনমনে জাল মেরামত করে যাচ্ছে । চারিদিকে ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা! কিন্তু জেলেদের মনে সুখ নেই। সদ্য তীরে ভেড়া এক জেলের সাথে কথা বলে জানলাম ৩ দিন নদীতে থেকে কেবল এক খাঁছি মাছ পেয়েছে। এতে পরিশ্রম তো বাদ, তাদের নৌকার তেলের খরচ উঠতেও নাকি মাঝেমাঝে কষ্ট হয়। প্রতিটা নৌকাতেই সোলার প্যানেল বসানো, তাই আলোর ঘাটতি চোখে পড়েনি।

হঠাৎ করে কল্পনায় অতীতে ফিরে গেলাম। কোন এক সময় জেলেদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে জেলেদের ক্রিয়া-কলাপ খুব কাছে থেকে দেখেছি। স্থান ভিন্ন হলেও এদের দু:খগুলো একি রকম। বাপ-দাদার করে আসা পেশা এরা শত কষ্টেও আঁকড়ে ধরে রাখে। পরিবারের সদস্যদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে এ মানুষগুলো কী হাড়ভাংগা পরিশ্রম ই না করে থাকে! দিন-রাত মাছের সাথে থেকেও বেশিরভাগ সময়ে এদের খাবারের পাতে মাছ জুটেনা। তবুও শত কষ্টের মাঝেও এদের মুখে ফুটে থাকে পবিত্র এক হাসি, আমার দেখা পৃথিবীর সরলতম হাসিগুলোর একটি।

কদিন পর অমাবস্যা। এ রকম অমাবস্যা কিংবা ভরা পূর্ণিমা তিথিতে নাকি এদের জীবনে মাঝে মাঝে ঈদ বয়ে আনে কারন এ সময় নদীতে জেলেরা প্রচুর মাছ পায়। শুনেছি, অনেক জেলের মেয়েসন্তান হলে তাই শখ করে তারা নাম রাখে পূর্ণিমা।

নদীর পাড় ঘেঁষেই অনেকগুলো চায়ের দোকান। আসার আগে আমরা সবাই মিলে চা খেতে এক দোকানে ঢুকলাম। হঠাত করে কানে বেজে উঠল এক তারার সুর,  সাথে বাঁশি আর তানপুরার অপূর্ব মিশেলে মাঝিমাল্লার গান। একসময় এগুলো নদীর পাড়ে গেলে হরহামেশাই শোনা যেত। এখন আর তেমন শোনা যায়না, সব যন্ত্র বন্ধি হয়ে গেছে। আমরাও তাই যন্ত্রবন্ধি গান-ই শুনলাম।

এখানে পুরো পাড়জুড়ে জেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছাগলের রাজত্ব।  আসার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ চোখ আটকে গেল তিনটি ছানাসহ একটি মা ছাগলের উপর। কি সুন্দর করে বসে তারা সমুদ্র দর্শন করছে! এখানকার ছাগলদের ও রুচিবোধ আছে, আছে সংগঠন। মারামারি লাগলে তা ভীষণভাবে টের পাওয়া যায়।

ফেরার পথে কয়েকবার পথ ভুলে হারিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডার এসে পৌছেছি। আলেকজান্ডার এসে সেই কলেজ বন্ধুর আতিথিয়েতায় বিখ্যাত মহিষের দইয়ের স্বাদ গ্রহণ করলাম। একে একে দু-গ্লাস খেয়েও অতৃপ্তি রয়ে গেলো। কেবল দই খাওয়ার জন্য হলেও বারবার আমি আলেকজান্ডার আসতে চাই। পুরো ট্যুরটাই অসাধারণ ছিল কেবল মটর সাইকেলের ঝাঁকুনির ফলে শ্রোণিদেশে ব্যাথা ছাড়া। ভাল থাকুক রামগতি, ভাল থাকুক সরলমনা জেলেদের সকল পরিবার যাদের কল্যাণে আমরা আজো রুপালি ইলিশের স্বাদের গল্প করতে পারছি।

লেখক : মো: ইমরান হোসেন,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Spread the love

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ



Design & Developed by Md Abdur Rashid, Mobile: 01720541362, Email:arashid882003@gmail.com