• ঢাকা,বাংলাদেশ
  • বুধবার | ৭ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | গ্রীষ্মকাল | সন্ধ্যা ৭:১৯
  • আর্কাইভ

রত্নগর্ভা ‘সায়েরার’ গল্প

৪:৩০ অপরাহ্ণ, ফেব্রু ১১, ২০১৮

বুড়ি টাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তবু যা না বললেই নয়। আমার দাদী সায়েরা খাতুন এক রত্নগর্ভা  জননী। যদিও সব বাবা মার কাছে সব সন্তানই রত্ন। কিন্তু তিনি যেন অনন্য। সেকালের একজন স্বল্পশিক্ষিত ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া এ নারীর মন মানসিকতা আধুনিক নারীদের ও হার মানাবে। খুব সহজ সরলা এক নারী। কারও কাছে তার কোন চাওয়া নেই, নেই কোন উচ্ছ্বাসা। শুধু আল্লাহর কাছে  প্রার্থনা তার পরিবার যেন সবসময় ভাল থাকে আর উন্নতি করে।

তার সংসারটা কিন্তু অনেক বড় হয়েও আজ ছোট। ১২ বছর বয়সে তার সংসার এর গ্লানি টানা শূরু। সুশিক্ষিত সুপ্রতিষ্ঠিত ৭ ছেলে সন্তানের ৭৩ বছর বয়সী জননী তিনি। দুই ছেলে এডভোকেট, একজন সরকারি কর্মচারী  হিসেবে রিটার্ড করেছেন, এক ছেলে ডাক্তার,একজন  সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার,ও একজন সহকারি শিক্ষক। শহরের চাকচিক্য জীবন ও জীবিকার তাগিদে সবারই শহরে বাস  কিন্তু উনার যেন স্বামীর ভিটাতে সর্বসুখ।

দাদা প্রায় ২০ টাকা বেতনের সরকারী স্কুলের শিক্ষকতা শুরু করেন। দাদীর  বিয়ের সময়কালীন বেতন প্রায়  ৫০ টাকা ছিল। শুধু বেতনের টাকা কি আর এত বড় সংসার চলে?পাশাপাশি  গ্রিহস্তি  বা কৃষি কাজ চলত। উনি পারতেন সব সন্তানদের চাষী বানাতে।

আজ থেকে ৫০/৬০ বছর পূর্বে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু উনি তা করেন নি। দাদা নাকি  অনেক  টা সময় ফেনীতে  চাকরী করেছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তিনি নিজ জেলা বদলি হয়ে এসেছিলেন।  এর আগে একা উনি যুদ্ধ,  দুর্ভিক্ষ, খরার মধ্য দিয়ে একটু  একটু করে  পরিবারটা এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কেউ কি সে কষ্ট সংগ্রামের গল্প কখনও কি শুনতে চেয়েছে?আমি নিজে ও শুনিনি। কদিন আগে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার জীবনের সব সময়ের কষ্টের সময় গুলো কখন? মনে পড়ে আপনার? বললেন,”যন গিরস্তি আছিল, পোলাপান গুলা পেটে নিয়ে অনেক কষ্ট করে গিরস্তের কাম শেষ করন লাগত। সে সময়গুলো ই ছিল অনেক কষ্টকর। তখন যে অসুখ বিসুখ ধরেছে আজ ও সারে নি।”সুখের কথা জানতে চাইলে সরল মনেই বললেন, “বিয়ের পরের সময়গুলোই ছিল অনেক সুখের। এছাড়া ওভাবে কিছু মনে পরে না”।  কথা টা শুনে মনের ভিতর একটা  ক্ষীন কষ্ট যেন হল। কারন আমরা ৩২ জন সদস্য তার পরিবারে। আমাদের কে নিয়ে তার সুখের কোন মূহুর্ত  নেই।থাকবে বা কি করে আমরা ত সবাই ব্যস্ত। আমরা কি কখন তাকে মনে রাখার মত কোন সময় উপহার দিয়েছি?

আমাদের বর্তমান শিক্ষিত সমাজে দেখেছি সামাজিকতা নামে যৌতুকের জন্য বউদের শ্বশুর-শাশুড়ির শারীরিক মানসিক নিপীড়ন সইতে হয়। কিন্তু আমার দাদীর সাতটি বউ কখন ও এই অভিযোগ তুলতে পারবে না। বউদের পড়াশুনা বা চাকরী নিয়ে বাধা দেয়াত দুরের কথা বরং  তিনি ছিলেন গর্বিত । এমন কি অনেক শিক্ষিত শ্বাশুড়িরা বউদের পোশাক,চলা ফেরা  নিয়ে ও অনেক সমস্যা করেন কিন্তু আমি  কখনো সেটা তার মধ্যে দেখিনি। দেখিনি সামাজিক কুসংস্কার তার মধ্যে কখনো ভর করতে।

মার কাছে শুনেছি,সব সময় উপমা দিত, আমি এতটাই ভাগ্যবতী ও আদুরে ছিলাম যে দাদা দাদী, আমার চাচারা মাথায় রাখতো না উকুনের ভয়ে মাটিতে রাখতো না পিপড়ার ভয়ে। কারন আমি উনার ৭ ছেলে সন্তানের পর প্রথম আদরের নাতনী।যার জন্য আমি ও অন্য সবার চেয়ে একটু  বেশি আদর পেলাম আর তার কাছাকাছি ছিলাম।

আজ এই বুড়িটার কাছ থেকে আমি অনেক দূরে। দেশে আমায় কে কতটা মিস করে তা আমি ফিল না করতে পারলেও এই বুড়িটার আমার জন্য অনুভুতি পুরোপুরি বুঝতে পারি।কারন  চোখে ঠিকমত না দেখলে ও কানে কম শুনলেও যখন কদিন পরপর মোবাইলে আমার নাম খুজে মিসকল দেয় তখন মনে হয় এখনি  ছুটে যাই তার কাছে,তার ভালবাসার কাছে।

বুড়ির রাগ আমি দেখেছি কখন জান? বুড়িটাকে বুড়ি  বললে খুব রাগ হয়।  যদি জানে আমি বুড়ী  নিয়ে লিখেছি, খুব রাগ হবে, কিন্তু সে ত বুজে না  এটা আদরের ডাক, ভালবাসার ডাক। তবু যা কখন বলিনি, আজ বলি, বুড়ি তোমায় অনেক ভালবাসি।

লেখক:- ফারজানা পুষ্পিতা।

Spread the love

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ



Design & Developed by Md Abdur Rashid, Mobile: 01720541362, Email:arashid882003@gmail.com