মো. নিজাম উদ্দিন : লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে গত ৯ জানুয়ারী। এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র এক শতাংশ।
তিন মাসে ১৯ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজের অগ্রগতিতে অসন্তোষ তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।
নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে তাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি।যদিও এরই মধ্যে শুষ্ক মৌসুম পার হতে চলেছে। আসছে বর্ষা মৌসুমে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। তাই দ্রুতই কাজ সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে কাজের ধীরগতি হিসেবে বালু সংকটকে দায়ি করেছে ঠিকাদার এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ‘মেঘনা নদীর বড়খেরী, লুধুয়াবাজার এবং কাদিরপন্ডিতেরহাট বাজার’ তীররক্ষা প্রকল্প নামের ৩৩.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটি ২০২১ সালের ১ জুন পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার পর উপকূলীয় বাসিন্দাদের মধ্যে স্বস্তি দেখা দিলেও তাদের দাবি ছিলো সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করার। এজন্য তারা মানববন্ধনসহ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। 
জানা গেছে, ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করানোর লক্ষ্যে গত বছরের ১৭ আগস্ট ই-জিপি টেন্ডার পোর্টাল এবং ১৮ আগস্ট পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। টেন্ডারের মাধ্যমে মোট ৩ হাজার ৪০০ মিটার কাজ করানোর নিমিত্তে ঠিকাদারদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর অংশ হিসেবে গত ৯ জানুয়ারি কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় একটি এবং রামগতিতে আরেকটি লটের কাজ উদ্বোধন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক।
কাজ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে দেয়। এতে সহসায় ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে এলাকার লোকজন দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আবারও আন্দোলনে নামে।
সোমবার (১১ এপ্রিল) দুপুরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার লুধুয়া এলাকায় এলকাবাসীরা একজোট হয়ে মানববন্ধন পালন করে কাজের ধীরগতির প্রতিবাদ জানায়।
পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাদের আশ্রয়স্থল রক্ষায় সরকারের নেওয়া তীর রক্ষা বাঁধ দ্রুত নির্মাণের দাবি জানিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন।
তাদের মধ্যে একজন মেঘনা তীরের বাসিন্দা বিবি সলেমা। দুই বছর আগে তিনি নদীর ভাঙনের শিকার হন। বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া এলাকায় একজনের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রিতা হিসেবে বসবাস করেন। নদীতে সবকিছু হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। নিজের জমি কেনার টাকা নেই, তার অন্যের আশ্রয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। সে আশ্রয়স্থলও হারানোর শঙ্কায় আছেন। কারণ মেঘনা তাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
একই এলাকার ভাঙনের শিকার গোলবানু, শারমিন আক্তার, আনোয়ারা বেগম ও জরিনা বেগমদের গল্প একই। তাদের ভাগ্যে ঘটেছে একই ঘটনা। এঁরা সকলে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে অন্যের জমিতে বসবাস করছেন।
ভূক্তভোগী এসব নারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর সরকার বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প দিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার কাজ না করার কারণে নদীর ভাঙন অব্যাহত আছে। দ্রুত বাঁধ দেওয়া হলে অনেকের বাড়িঘর রক্ষা পাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মাস্টার, সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজ হাওলাদার, জাহাঙ্গীর তালুকদার, আবু সিদ্দিক, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল করিম ও রাকিব হোসেন লোটাস বলেন, প্রতিনিয়ত মেঘনা নদীর করাল গ্রাসে তারা সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। দিন যতই যাচ্ছে, ততই মেঘনা গিলে খাচ্ছে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, হাট বাজার, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। তাই দ্রুতই বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়েও তারা ঠিকমতো কাজ শুরু করেনি। জিও ব্যাগ ডাম্পিং এর জন্য বালু সংকট দেখিয়ে তারা কাজ শুরু না করতেই বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে ভাঙনরোধ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
তারা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, আমাদের দাবি ছিলো ঠিকাদারের মাধ্যমে তীররক্ষা বাঁধের কাজ না করিয়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার। কিন্তু ঠিকাদার কাজ শুরু না করতেই বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শুষ্ক মৌসুম যাচ্ছে, এ সময়টাতে বাঁধ নির্মাণের উপযুক্ত সময়। বর্ষাতে নদীতে অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে পানির চাপ বেড়ে যায়। তখন ভাঙন প্রতিরোধের কাজ ব্যাহত হয়। কিন্তু অসাধু ঠিকাদারা বালু সংকটের অজুহাত তুলে কাজ বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা চাই প্রয়োজনবোধে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নদীর তীরে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করার। এছাড়া বাঁধ নির্মাণে যাতে দুর্নীতি না হয়, সেজন্য সরকারের নজরদারি দাবিও জানাচ্ছি।
জানা গেছে, বিগত ৩০ বছরে মেঘনা নদীর ধারাবাহিক ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময় ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক বাসিন্দা।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ঠিকাদাররা চাঁদপুর থেকে বালু এনে জিও ব্যাগ ড্যাম্পিং এর কাজ করতো। কিন্তু সেখানে বালু সংকটের কারণ দেখিয়ে তারা সাময়িক কাজ বন্ধ রেখেছে। আমরা তাদেরকে কাজ দিয়েছি- তারা কোথা থেকে বালু সংগ্রহ করবে সেটা তাদের বিষয়। আমরা ঠিকাদারকে চিঠি দিয়েছি, তারা যেন কাজ বন্ধ না রেখে কাজ চালিয়ে যায়। আশাকরি আগামী ৫-৭ দিনের মধ্যে তারা কাজ শুরু করবে।
তিনি বলেন, এ শুষ্ক মৌসুমে শুধুমাত্র ডাম্পিং এর কাজ করা যাবে। ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ আগামী শুষ্ক মৌসুমে শুরু করা যাবে।
ফারুক আহমেদ জানান, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার নদীর তীরবর্তী বাঁধ নির্মাণ কাজ ৯৯ ভাগে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। এরমধ্যে ২৪ টি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ১৯ জন ঠিকাদার কাজ শুরু করেছেন। বাকী ৫ জন ঠিকাদার কাজ শুরু করবেন।
কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি জানান, এ পর্যন্ত মাত্র এক ভাগ কাজ করা হয়েছে।