৬:৩৮ অপরাহ্ণ, অক্টো ২৯, ২০১৭
আমার পরিচিত জনদের মধ্যে যাদের নেদারল্যান্ডস দেশটি, ডাচদের জীবনযাত্রা ,এবং তারা মানুষ হিসেবে কেমন,তা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই তাদের জন্যই আমার আজকের এ লেখা। দুই বছর ৪ মাসে আমি যতুটুকু দেখেছি সে অভিজ্ঞতার কথাই বলছি।স্বভাবত আমি একটু মিশুক বলে এখানে অনেক ডাচ মানুষের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে,তাদের দেখে আর তাদের থেকে এসব তথ্য নিয়েছি।
নেদারল্যান্ডসের পূর্ব নাম হল্যান্ড । নেদারল্যান্ডসের স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্রের জলতলের থেকে অনেক নিচু।তাই বাঁধ দিয়ে পুরো দেশটা ঘিরে রাখা হয়েছে। সে বাঁধ অবশ্য আমাদের দেশের মতো নয় যে, সামান্য জলচ্ছ্বাসেই ভেঙে যাবে ! নাগরিকরাও বাঁধ নিয়ে খুবই সচেতন। এ ছাড়া জলতলকে সমান রাখার জন্য আরও একটি উপায় অবলম্বন করে তারা। গোটা দেশ জুড়ে প্রচুর খাল কাটা আছে। সমুদ্রের সঙ্গে এই খালগুলির যোগাযোগ আছে নদীর মাধ্যমে। এ ভাবে ভৌগলিক অসুবিধাগুলিকে এ দেশের মানুষ অনেকটা অতিক্রম করতে পেরেছে। খালগুলির উপর রীতিমতো নৌবিহার করা যায়। ফলে,সমগ্র দেশে একটা পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে ব্যবস্থা এমনই যে,গোটা দেশেই জলপথে ভ্রমণ করা যায়। কখনও খালের উপরে রাস্তা,কখনও বা সে রাস্তা খালের নীচে দিয়ে। ছোট্ট দেশ,অথচ কী সুন্দর সাজানো গোছানো !
নেদারল্যান্ডস খুবই ছোট দেশ।আয়তনে ৪১৫৪৩ km2 জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লক্ষ। ইতিহাসের পাতায় আমরা যাদের ওলন্দাজ বলে চিনি, এরাই তারা।এরা ছিল প্রধানত নাবিক। প্রত্যেকে বেশ লম্বা,ফর্সা গায়ের রঙ ।
নেদারল্যান্ডস এর জাতীয়তা নেদারল্যান্ডারস । মাতৃভাষা নেদারল্যান্ডস, মাতৃভাষাকেই ইংরেজিতে ডাচ বলে । বর্ণমালাগুলো ইংরেজি বর্ণমালার মত দেখতে হলেও এর প্রতিটি অক্ষরের উচ্চারণ সম্পূর্ণ আলাদা । তাদের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনেক। ক্ষেত্র বিশেষে ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে । তবে খুব কম । সে জন্যই হাইস্কুলে এখন ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ।
নেদারল্যান্ডস এর প্রতিটি সিটির বাড়ি এবং বিল্ডিং এর অবকাঠামো অনেকটা একইরকম ,পৌরসভা বাড়ী তৈরি করে অথবা ডিজাইন তৈরি করে দেয়। সে জন্য একই রকম বাড়ি ।আর এ কাঠামো শহরের শোভা বৃদ্ধি করেছে। শহরের বাইরে গ্রামে গেলেও এর কাঠামোর পরিবর্তন দেখিনি । বাড়ি তৈরি করতে কাঠের ব্যাবহার সর্বাধিক ব্যবহার হয় ।
নেদারল্যান্ডের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি । সারাবছরই তারা কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখে । গ্রীষ্মকালে বাইরে এবং শীতকালে তারা গ্রীন হাউস উৎপাদন করে। নেদারল্যান্ডের কৃষকরা দেশের প্রথম শ্রেণির ধনী।
ডাচদের প্রধান খাদ্য ব্রেড,আলু ,সালাদ।আর এই ব্রেড এর সাথে অন্তত হাজার রকমের উপকরণ আছে যা মিলিয়ে তারা খেতে পছন্দ করে। মাসে একবার কিংবা দুবার ভাত খায় বললেই চলে ।খুব অবাক হয় যখন শুনে আমরা ৩ বেলা ভাত খাই বাংলাদেশে।তাদের খাবার সময়সূচী > সকাল ৮ টা ব্রেকফাস্ট, দুপুর ১ তা লাঞ্চ,সন্ধ্যে ৬ টা ডিনার । এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই সময়টায় এখানে গরমকাল। রাত ১০টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে। সম্পূর্ণ অন্ধকার নামতে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা বেজে যায়। সূর্যোদয়ও হয় খুব ভোরে। শীতকাল যত এগিয়ে আসে, ততই দিনের ব্যাপ্তি কমতে থাকে।তারপরও তারা ঘড়ির কাঁটা মেপে চলে । ডিনারে তারা ভারী গরম খাবার খেতে পছন্দ করে । তাই দিনে একবার রান্না করে ।আর দুজনে কর্মজীবী হলে ছুটির দিনে শনিবার / রবিবারে ,স্পেশাল রান্না করে বা বাইরে খাওয়া হয়।
ডাচরা খুব পরিশ্রমী । শত শত বছরের পরিশ্রমের ফসল আজকের এই নেদারল্যান্ডস ।আর সে জন্য আজ তারা বিশ্বের একটা উন্নত দেশ হয়ে দাড়িয়ে আছে । এখানে আইন যেমন আছে তেমনি তার যথাযথ প্রয়োগ ও আছে।অতিরিক্ত জরিমানা দেবার ভয়ে কেউ আইন অমান্য করে না ,আর সেটা ছোট হোক বড় হোক । এ দেশের কারাঘার গুলো কয়েদির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ,সে সম্পর্কে প্রতিবেদন আমরা অনেক দেখেছি । আর কয়েদির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না করে রয়েছে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থা ।
ধর্মীয় দিক থেকে এরা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তক হলেও,বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের ধর্ম নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই । সব ধর্মই সমান তাদের কাছে ,সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করে।এ দেশে চার্চ এর সংখ্যা ৪২০০ এর মত ।আর প্রতিটি চার্চ ৫০০/৬০০ লোকের উপযোগী করে বানানো। কিন্তু রবিবার ছুটির দিনেও তারা শতকরা ৫ জন লোক ও চার্চ এ যায় না ,আর তাই বেশিরভাগ চার্চই বন্ধ হয়ে গেছে।কারণ তাদের কথা হল যে সময় আমি চার্চে গিয়ে ঈশ্বর এর কাছে প্রাথনা করব সে সময়টা অন্য কারও ঊপকার করলে ,তার ভাল হবে ,নিজের শরীর ও ভাল থাকবে ,ঈশ্বর খুশি হবে ,দেশের উপকার হবে। আর এটাই যেন তাদের এবাদত।আর তাই তারা ফ্রী কোন না কোন কাজের সাথে যুক্ত। কেউ কোন প্রতিষ্ঠান বা নিজে বিজ্ঞাপন দিয়েও ফ্রী সামাজিক কাজ করে ।এমনকি বয়স্করাও ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে না ।
আরও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সময় সম্পর্কে সচেতনতা। ডাচদের কাছে appoinment is appoinment.কারও সাথে কোন appoinment করলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা হাযির হবে ,কোন কারণে ৫ মিনিট দেরি হলেও সেটা আগেই টেলিফোন বা ইমেইল এ জানিয়ে দিবে ,দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচি আখেন্দা নামক ছোট ডায়েরী ব্যাবহার করতে তারা অভ্যস্ত ।তারা সেটাই মেনে চলে ।
নেদারল্যান্ড ফুলের দেশ।বছরের শীতের সময়টা বাদে অন্য সময়টা ফুলে ভরপুর থাকে।আর তাই সবাই ব্যাস্ত হয়ে যায় নিজের বাড়ির সামনের আর পিছনের বাগান সাজাতে।
বেশির ভাগ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ী থাকলেও তারা সাইকেল ব্যাবহার করে ,এমন কি নেদারল্য্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী / রাষ্ট্রপতি ও মাঝে মাঝে সাইকেল এ গিয়ে অফিস করে ।
(লেখক:নেদারল্যান্ড প্রবাসী, ফারজানা পুষ্পিতা’র ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া)
৭:৫৯ অপরাহ্ণ, নভে ১২, ২০১৯